উপ-সম্পাদকীয় :
২০২০ সালের বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫০। মহামারী আসার পরে ২০২১ সালের বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে, ৬৫-তে নেমে গিয়েছে। সুতরাং আশঙ্কা করা যেতে পারে যে কভিড-১৯ বাংলাদেশের অনেক অর্জনকেই ম্লান করে দিতে পারে।
এ বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস যে বাণী দিয়েছেন তার মর্মকথা হলো, কভিড-১৯ মহামারী জেন্ডার সমতার কয়েক দশকের অগ্রগতি বিনষ্ট করে ফেলেছে।
তবে মহামারী মোকাবেলায় নারীরা প্রথম সারির ভূমিকা পালন করছেন। মহামারীর এ সময়ে তারা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং অর্থনীতি, সম্প্রদায় ও পরিবারগুলোকে একত্রে ধরে রাখার জন্য অত্যাবশ্যক কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
দেশের রফতানি খাতের ৮০ শতাংশই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) থেকে আসে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প করোনা সংকটে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২০-এর এপ্রিলের প্রথমার্ধে পোশাক খাতে মোট ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন অর্ডার বাতিল করা হয়।
পোশাক অর্ডার বাতিল হওয়ায় অনেক পোশাক কর্মী তাদের চাকরি হারান। অনেক পোশাক কারখানা কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই তাদের কর্মীদের চাকরিচ্যুত করে। পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটস ও ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম ডব্লিউআরসি কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্ডার বাতিলের কারণে বাংলাদেশে এক মিলিয়নেরও বেশি পোশাক শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে। ২৫ মার্চ ২০২০-এ বাংলাদেশ সরকার পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাবদ ৫৮৮ মিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্যাকেজ ও বেলআউটের জন্য ৭৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ফান্ড ঘোষণা করে। এ প্যাকেজ শ্রমিকদের জন্য কেবল এক মাসের বেতনের সংস্থান করতে পারে। এটি ছাড়া শ্রমিকদের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদেয় কোনো সুরক্ষা নীতি নেই, যেখানে তারা নির্ভর করতে পারে।
২০২০ সালের অক্টোবরে এক গবেষণায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, তৈরি পোশাক কারখানাগুলো মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে তাদের জনশক্তি ৮ শতাংশ কমিয়ে দেয়, আর চাকরি হারানো পোশাক কর্মীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ৬১ শতাংশ। কভিড-১৯ শুরু হওয়ার আগে তৈরি পোশাক কারখানায় নারীদের সামগ্রিক অনুপাত ছিল ৬২ শতাংশ। এটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশে।
আমরা দেখেছি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কৌশলটি ছিল ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সাময়িকভাবে পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়া। পরবর্তী সময়ে পোশাক শিল্প রক্ষার লক্ষ্যে কারখানাগুলো খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যবসায়ী, কর্মী ও কারখানার মালিকরা এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেও মানবাধিকার কর্মীরা এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রকাশ করে, ১৪টি দেশীয় পত্রিকার তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৬২২ জন নারী ও মেয়ে শিশু সহিংসতার শিকার হন (দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২০২০, জানুয়ারির অনলাইন রিপোর্ট)। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৬ মার্চ থেকে ৩ জুনের মধ্যে সহিংসতার মোট ১৯৭টি মামলা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৬টি ধর্ষণের মামলা, ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে এমন মামলা ১৪টি, যৌতুক সম্পর্কিত সহিংসতা মামলা ৫১টি, অপহরণের মামলা ৩৬টি, যৌন হয়রানির ঘটনা ১৮টি এবং শারীরিক সহিংসতার ঘটনা সাতটি (দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ জুন, ২০২০)। পুলিশ প্রাথমিকভাবে মহামারীর জন্য বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মনোনিবেশ করায় তারা নারীদের প্রতি সহিংসতা সম্পর্কিত মামলায় কম মনোযোগ দেন। মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পরে আদালতও কয়েক মাস বন্ধ ছিল। এ ঘটনাগুলো নারীদের পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করেছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে লকডাউন সময়কালে দেশে নারীদের প্রতি সহিংসতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন লকডাউনের মধ্যে বাল্যবিবাহের কারণ সম্পর্কে জানায়, ‘প্রথমত করোনার কারণে মানুষের দারিদ্র্য বেড়েছে। তাই অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দারিদ্র্য থেকে বাঁচার হয়তো একটা পথ খুঁজছেন। আর এ সময়ে বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচার ও তত্পরতা কমে যাওয়ায় এটাকে কেউ কেউ সুযোগ হিসেবে নিয়েছে।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কিছু সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে হটলাইন ১০৯ ও পুলিশি সহায়তার জন্য ৯৯৯-কে আরো বেশি কার্যকর করা। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় নারীরা যাতে আশ্রয় পেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা। করোনা পরিস্থিতিতে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল চলমান রাখার জন্য ‘ভার্চুয়াল কোর্ট অর্ডিন্যান্স’ দ্রুত পাস করা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। তাই নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন যেমন অসম্ভব, তেমনি নেতৃত্বে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া জেন্ডার সমতা ও সুশাসন নিশ্চিত করাও সম্ভব নয়।’
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, কভিড-১৯ অতিমারীকালে ৩০ দশমিক ৫৪ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ৭৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ নারীর দৈনন্দিন জীবনাচার নিয়ন্ত্রণ এবং ৩৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ নারী অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। আর ৪৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন উভয় ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি এ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এবং পারিবারিক উপার্জন হ্রাস পাওয়ায় বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়া নারী শিক্ষার্থীর হার বাড়ছে। অথচ টেকসই উন্নয়নের জন্য নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন জরুরি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৫-এ নারীদের সমঅধিকার এবং নারী ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই সব পর্যায়ে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব এবং সমঅধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হলে টেকসই উন্নয়ন অর্জন অসম্ভব।
নারীর সমতা ও দারিদ্র্যের ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ উপদেষ্টা বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, পরিকল্পনা কমিশনের জন্য একটি নীতিপত্র তৈরি করতে গিয়ে দেখা গেছে লকডাউনের সময় পরিবার পরিকল্পনা সেবা অনেকাংশে ভেঙে পড়েছিল। এমনকি শুধু বেসরকারিই নয়, সরকারি সেবার ক্ষেত্রেও তা-ই। এছাড়া নারীরা বেশি কাজ করেন সেবা খাতে। এ খাতটি বিরাট ধাক্কা খেয়েছে।
পিপিআরসি ও বিআইজিডি গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় নারীদের জীবিকা ফিরে পাওয়া কঠিন হচ্ছে। এটির প্রধান কারণ তাদের পেশার ধরন। যেমন পোশাক শিল্পে যারা কাজ করতেন তারা হয়তো অনেকেই ফিরে এসেছেন। যদিওবা করোনাকালীন তাদের রোজগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যারা গ্রামে চলে গিয়েছেন তাদের ফিরে আসা কঠিন হচ্ছে। জীবিকা ফিরে পাওয়া নির্ভর করে কাজের ধরনের ওপর। যেমন রিকশাচালকরা কাজ বন্ধ করে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারা আবার ফিরে এসেছেন।
অনেক নারী রাস্তার পাশে খাবার দোকান দিয়েছিলেন। ব্যবসাটি আবার সেভাবে চালু করা কঠিন। নারীদের অধিকাংশই অতিদরিদ্র, নিঃসহায় নারী, অনেকেই স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন এসব নারীর ক্ষেত্রে আবার উঠে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে অন্য অংশটি দারিদ্র্য রেখার ওপরে থাকা নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যমধ্যবিত্ত মানুষ, তারাও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত। তারা বর্তমানে নতুন দরিদ্র বলে বিবেচিত হচ্ছে।
এছাড়া গত বছরের মার্চ থেকে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুল বেতন দিতে পারছে না। কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা ধরে নিতে পারি এ খাতে কর্মীদের একটি বড় অংশ নারী।
বিউটি পার্লারগুলোর কর্মীরা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই নারী। ধীরে ধীরে কিছু বিউটি পার্লার খুলছে। এছাড়া ছোট এনজিও, বিশেষত আঞ্চলিক এনজিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরা সাধারণত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করতেন। তাদের তহবিল সংকট বেড়েছে। এদের বড় অংশের চাকরি প্রথমবারের মতো চলে গেছে, হয়তো ফিরে পেতেও পারেন।
বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত একটি সেবাদানকারী বড় খাত। এখন দেশজুড়ে অনেক বেসরকারি ক্লিনিক আছে। তাদের অনেকেই চাকরি ফিরে পাবেন কিনা সঠিক বলা যায় না।
কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা চরম ক্ষতিতে পড়েছেন। এদের ক্ষতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এর সঙ্গে নিয়োজিত নারী কর্মীরা।
আমরা দেখেছি সরকার শিল্পের প্রণোদনা দিতে বেশ উদার হয়েছে। কিন্তু অনায়াসে বলা যায় ঝোঁকটা ছিল বড় উদ্যোক্তাদের প্রতি। এক্ষেত্রে প্রণোদনা বিতরণের ভার দেয়া হয়েছে ব্যাংককে। যেখানে নারীদের উপস্থিতি কম। নারী উদ্যোক্তাদের বড় সমস্যা হচ্ছে তারা ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এক্ষেত্রে এসব নারীকে সহযোগিতা দেয়ার উপায় কী। উপায় হলো সরকারি সংগঠনগুলোর আরো নিবিড়ভাবে কাজ করা। প্রথমত, এ খাতে বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ দিতে হবে। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে স্থানীয় সরকারকে। স্থানীয় সরকারের কাছে তথ্য থাকা স্বাভাবিক উচিতও বটে। সার্বিকভাবে সর্বত্রই মানবিক কাজে মানুষকে অগ্রগামী হতে হবে।
আমরা দেখছি বাজেটের মূল ঝোঁক সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা। সেই বরাদ্দ দুর্নীতিমুক্তভাবে সদ্ব্যবহার করা হলো কিনা, সেটি তদারকির জন্য বাজেট রাখা চাই।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। লেখক তার গ্রন্থে বলেছেন, ‘মানুষের ইতিহাস তুলনামূলক সুস্থভাবে সুস্থ পরিবেশে টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষার লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। এ লড়াই-সংগ্রাম নিরন্তর। মানুষ এ লড়াই করেছে কখনো একা একা, কখনোবা যূথবদ্ধভাবে। এ লড়াইয়ের শুরুটা মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই দিয়ে নয়। শুরুটা সম্ভবত হয়েছিল মানুষের সঙ্গে তার চারপাশের প্রকৃতির সঙ্গে; অসীম প্রকৃতিতে টিকে থাকার লড়াই। তবে আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতি ততক্ষণ মানুষের প্রতি বিরাগভাজন হয়নি, যতক্ষণ না মানুষ তাকে মাত্রাতিরিক্ত করেছে, আসলে প্রকৃতি কখনো বিরাগভাজন হয়নি—সে তার নিজ নিয়মে কাজ করেছে মাত্র। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের সম্ভবত সবচেয়ে বড় লড়াইয়ের শুরু শারীরিক ক্ষুধা নিবৃত্তির উত্তরোত্তর অধিকতর প্রয়োজনীয়তা থেকে। এ লড়াইয়ের শুরুতে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রকৃতি মানুষকে না চাইতেও খাইয়েছে। কারণ ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য গাছের ফলমূল, তৃণলতা, পোকামাকড়, মৃত-জীবিত পশুপাখি, জলের মাছ, নির্মল বাতাস—এসব তো মানুষ না চাইতেই প্রকৃতিতে পেয়েছে। আর প্রাণিজগতে অন্যদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেও তেমন কোনো বাধা ছিল না—প্রকৃতির দিক থেকে। আসলে মানুষ নিজেই এ বাধা সৃষ্টি করেছে—সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, আর মানুষ সমুদ্রকে শত্রু ভেবেছে; জঙ্গলে আগুন ধরেছে, আর মানুষ আগুনকে শত্রু ভেবেছে; শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে আর মানুষ শৈত্যপ্রবাহকে শত্রু ভেবেছে; বন্যা হয়েছে আর মানুষ বন্যাকে শত্রু ভেবেছে; আকাশে মেঘের গর্জনসহ তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, আর মানুষ তার মাথার ওপরের আকাশকে শত্রু ভেবেছে। প্রকৃতিকে এই শত্রু ভাবা দিয়েই প্রকৃতির শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের শুরু। লড়াইটা বলা চলে একতরফা। কারণ লড়াইটা ঘোষণা করেছে মানুষ—প্রকৃতি নয়। এ লড়াই নিরঙ্কুশ অসম লড়াই এবং এ লড়াইয়ে মানুষ কোনো দিনও জিতবে না; জিততে পারে না। কারণ আপনি আপনার নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করলেও করতে পারেন, কিন্তু কখনো জিতবেন না; আর জিতলেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারাতে হবে অথবা নিজেকেই হারাতে হবে। প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রকৃতির বিরুদ্ধেই লড়াই ঘোষণা—মানুষের দিক থেকেই এক নিরঙ্কুশ অন্যায়-অসম ঘোষণা।
মানুষ হিসেবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করে আমরা যে বোকামি করেছি, তা সম্ভবত কয়েক কোটি বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা বুঝিনি, বুঝতে চাইনি, বোঝার প্রয়োজনও বোধ করিনি। উল্টো আমরা প্রকৃতিকে বশ করতে চেয়েছি।’
আমরা দেখছি ৩১ অক্টোবর ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের ২৬তম কনফারেন্স অব পার্টি (কপ-২৬) শুরু হয়েছে। এ সম্মেলনে ১২০টি দেশের সরকারপ্রধানরা উপস্থিত হয়েছেন এবং দুই শতাধিক দেশের প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।
সম্প্রতি নেচার জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হয়, তাহলে আমাদের ৮৯ শতাংশ কয়লার মজুদ, ৫৮ শতাংশ তেলের মজুদ এবং ৫৯ শতাংশ মিথেন গ্যাসের মজুদ প্রকৃতিতে যেভাবে আছে সেভাবে রেখে দিতে হবে।
কপ-২৬-এ আমরা কিছু আশার আলো দেখতে পাই। এ সম্মেলনে চারটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে—ক) জলবায়ু অর্থায়ন, খ) কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা, গ) পরিবহন খাতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করা, ঘ) বনাঞ্চল সংরক্ষণ। গত ২ নভেম্বর শতাধিক দেশ, যারা পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ বনাঞ্চলের অধিকারী, তারা ঘোষণা দিয়েছে যে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বনাঞ্চল ধ্বংসের কার্যক্রম বন্ধ করবে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ৩০টি ফুটবল মাঠের সমান বনাঞ্চল প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছর বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের জন্য ১৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য, যারা এ বনাঞ্চল রক্ষায় প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে।
এছাড়া উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, মিথেন গ্যাসের নিঃসরণকে আগামী এক দশকের মধ্যে ২০২০ সালের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা হবে। এতে ৯০টি দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সম্মেলনে ৪০টিরও বেশি দেশ কয়লাচালিত বিদ্যুতের প্লান্টগুলো ২০৩০-৪০ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, এখন পর্যন্ত যতখানি জানা যায়, করোনাভাইরাসের মূলে হলো এক ধরনের প্রকৃতির প্রতিশোধ। এটি কোনো একক দেশের ভুলের কারণে নয়। এটি বিশ্বের জনগণের সচেতনতার বিষয়, যৌথ উদ্যোগের বিষয়। এ উদ্যোগ গড়ে তোলা বিশ্বের প্রতিটি নীতিবান মানুষের দায়িত্ব। আসুন, আমরা উদ্যোগে শামিল হই।
হান্নানা বেগম: অর্থনীতিবিদ, সাবেক অধ্যক্ষ, ইডেন গার্লস কলেজ, ঢাকা
//এমটিকে