কুমিল্লার উপভাষার আদ্যোপান্ত উম্মে তামিমা ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব,সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা গড়ে উঠেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি উপভাষা হল কুমিল্লার উপভাষা।
বর্তমান কুমিল্লা জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনস্থ একটি জেলা। শুরুর দিকে এটি সমতট জনপদের অন্তর্গত হলেও পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছিল। দ্রুদিয়ান কলিংস এক সময় এই জনপদে ‘কমলাঙ্কা’ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।ধারণা করা হয়, এই ‘কমলাঙ্কা’ থেকেই কুমিল্লা নামের উৎপত্তি হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত এই কুমিল্লা জেলাকে ঘিরে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, ঢাকা বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যান্য জেলাসমূহ। এই কুমিল্লা জেলার অধিবাসীরা যে বিশেষ উপভাষা ব্যবহার করে থাকেন, তা-ই কুমিল্লার উপভাষা নামে পরিচিত। কুমিল্লার উপভাষায় অনেক ক্ষেত্রে মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এছাড়াও সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ক) কুমিল্লার উপভাষার ভাষারীতিতে সাধারণত সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।বিভিন্ন ব্যঞ্জনধ্বনি সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনিরূপে লিখিত হলেও উচ্চারণের সময় তা ভেঙে যাওয়ায় অসংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হয়।যেমন- তেইল্লা চোরা (তেলাপোকা) এর উচ্চারণ হবে তেইল-লা চোরা, হুইত্তা(শুয়ে) এর উচ্চারণ হুইত-তা। এরকম কিছু শব্দ হলো নাইল্লা (পাট), মাইল্লা(ডাটা শাক), গুড্ডি(ঘুড়ি), মেন্নত(মেহনত), অক্করে(একেবারে), পইক্কা(পাখি), মুছল্লা(জায়নামাজ), বেইন্নালা(সকালবেলা), মাদাইন্নালা(বিকালবেলা)। খ) এ উপভাষার উচ্চারণে ‘ই’ বা ‘উ’ ধ্বনির আগমন অর্থাৎ অপিনিহিতর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন-বাক্য>বাইক্য,কলিজা>কইলজা, ভাগ্য>ভাইগ্য,দেখিয়া>দেইখ্যা।গ) এ উপভাষায় মধ্যস্বরাগমের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
গ্রাম>গেরাম, প্রাণ>পরাণ, ভ্রু>ভুরু, তৃষ্ণা >তিরাষ। ঘ) কুমিল্লার উপভাষায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহাপ্রাণ ঘোষ ধ্বনি গুলোর যেমন- ঘ,ঝ,ঢ,ধ,ভ এর উচ্চারণ যথাযথ ভাবে হয় না। এর পরিবর্তে ধ্বনিগুলো অল্পপ্রাণ ঘোষ হয়ে যায়। যেমন- ঘর>গর,ঢেঁকি >ডেহি, ধান>দান,ভর্তা>বর্তা। ঙ) তাদের ভাষায় অধিকাংশ শব্দের শুরুর শ,স ধ্বনির উচ্চারণ ‘হ’ ধ্বনি হয়ে যায়। যেমন- শুনবো>হুনমু, সেদিন >হেদিন,সোনালু ফুল>হুনাল ফুল,শলার ঝাড়ু >হলার পিছা,শাক>হাক,শুঁটকি >হুটকি,শুয়ে >হুইত্তা,শামুক>হামুক। চ) এছাড়াও তাদের ভাষায় অধিকাংশ ‘খ’ ধ্বনির উচ্চারণ ‘হ’ হয়ে যায়। যেমন- এখন>এহন/অহন,দেখা>দ্যাহা,মুখে>মুহে। ছ) এ ভাষারীতির ক্রিয়ারূপেও বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন- যায়াম(যাব), পারতাম না(পারবো না),যাইজ্ঞামু(চলে যাব)।তবে কুমিল্লার কোনো কোনো অঞ্চলে যামু(যাব), পারমু না(পারবো না) এ ধরনের ক্রিয়ারূপও প্রচলিত আছে। জ) এ ভাষায় কিছু বিশেষণসূচক শব্দ পাওয়া যায়। যেমন-কালা(কালো),বালা(ভালো),ডক(সুন্দর), লাম্বা(লম্বা),বাইট্টা(খাটো),বেডক(শ্রীহীন)।ঝ) এ ভাষারীতিতে -অলা,-আমি,-তে,-রে,-গ্যা প্রভৃতি প্রত্যয়/বিভক্তির ব্যবহার পাওয়া যায়।যেমন- টেহাঅলা(টাকাওয়ালা), পোংডামি(শয়তানি),হগলতে(সবাই),তোমগরে/তোমডারে(তোমাদেরকে),দেইগ্যা(দে গিয়ে)। ঞ) এ উপভাষায় লগে(সঙ্গে),মইধ্যে(মধ্যে), তে(হতে),চে(চেয়ে),বিতরে(ভেতর) প্রভৃতি অনুসর্গ এবং আতকা(হঠাৎ), নাইলে(নতুবা),তো, যহন – তহন প্রভৃতি অব্যয় পদের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও সম্ভাবনা প্রকাশে বাক্যে ‘যদি’ অব্যয়ের পরিবর্তে ‘অইলে’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন- হ্যাতে বালা কইরা পরালেহা করলে বালা ফল করলো অইলে( যদি সে ভালো করে পড়ালেখা করতো, তাহলে সে ভালো ফলাফল করতো)। ট) এ উপভাষায় শব্দের শুরুতে ‘এ’ ধ্বনির বিবৃত উচ্চারণ পাওয়া যায়। যেমন- দ্যাশ(দেশ), দ্যাহা(দেখা) ইত্যাদি। ঠ) এ ভাষারীতিতে একবচনে ‘ডা’ নির্দেশক এবং বহুচনে ‘ডি’ নির্দেশকের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন- টেহাডা(টাকাটা), আমডি(আমগুলো)। তবে কখনও কখনও ‘ডা’ বহুবচন নির্দেশেও ব্যবহৃত হয়। যেমন- আমডা (আমরা)। ড) কুমিল্লার উপভাষায় ব্যক্তিবাচক সর্বনামেরও বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন- তে/হ্যাতে (পুরুষবাচক ‘সে’), হেতি/তাই(স্ত্রীবাচক ‘সে’), আমনে/আপনে(আপনি),আমডা(আমরা), তোমডা(তোমরা),হ্যারা(তারা),অয়(ও)। ঢ) এ উপভাষায় প্রশ্নসূচক বাক্যের শেষে ‘নি’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- আমনে হেন যাইবেন নি?( আপনি কি সেখানে যাবেন?)ণ) কুমিল্লার অধিবাসীরা তাদের ভাষারীতিতে বিশেষ কিছু শব্দ ব্যবহার করে থাকে। এগুলো হলো- গয়াম (পেয়ারা),কিতারে(কিরে),হেছা(সত্যি),কতা(কথা),ইতান(এসব),এনদা(এদিক দিয়ে),হেনদা(সেখান দিয়ে),এনো(এখানে), হেন(সেখানে),হাবলাইয়া(তাড়াতাড়ি),খের(অপেক্ষা কর),পাহাল(মাটির চুলা),আতাল(হাঁস-মুরগীর খোঁয়াড়), হোরা দে(ঝাড়ু দে),বিছুন(হাতপাখা),আগার দিয়া(সামনে দিয়ে), কাইক (পা বাড়ানো),আডে না(খাপ খায় না),আন্তাজে(না জেনে),তেলকা(ঠান্ডা), পানসা(জলবসন্ত), উলুশ(ছারপোকা), বইয়া(বসে),হগলডি(সবগুলো),কেরে/কিত্তি(কেন),ছুইটকা/আবু গেন্দা (শিশু), কাইজ্যা(ঝগড়া), বুর পারা(পুকুরে গোসল করা),যেতলা(যতগুলো),পুত(ছেলে),কোনডি(কোনগুলো), ছোড(ছোট), শইল(শরীর),কাউয়া(কাক),ডেহা(বাছুর), বুবু(দাদী),বাইত(বাড়িতে), লইয়া(নিয়ে),হউরা(সরিষা),হজের পাতা(ধনিয়াপাতা), কনি দেম(মাইর
দিব),বয়রা(বহেরা),বেন্ডি(ঢেঁড়স),কইডা(কহি),হাইনজালা(সন্ধ্যাবেলা),দুয়ার(দরজা),পিছদুর(পিছনের দরজা), চুকা/চুয়া(টক),রউন(রসুন),কচলাইয়া(ঘষে), পিন্দা(পরিধান করা),ছৈঁ(শিম),হুমাস/নিয়াশ(নিশ্বাস),কো(কোথায়),কোন মুহুল/কোন ফাইল(কোন দিকে),কান্দা(পাড়),রইদ(রোদ), তেতুই(তেঁতুল), খারি/ওরা(ধান রাখার বেতের বড় পাত্র), রসা(তরকারির ঝোল),জিংলা(সরু কাঠি),হেন্(ভাতের মাড়),রাউতকা(রাতে),মাইজ্জা(মেজো),কি লাইগ্যা(কীসের জন্য),টেটনা(চালাক),বিসুৎবার(বৃহস্পতিবার), হুমা(শসা),
কুমিল্লার উপভাষা বর্তমানে ভাষা বিপন্নতার অনিরাপদ অবস্থানে রয়েছে। এ ভাষাটি এ অঞ্চলের সব প্রজন্ম স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করলেও এটি অনিরাপদ কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে এ উপভাষাটি ব্যবহৃত হয় না। শুধুমাত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয়। এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলার লাড়ুচো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ রাজিব হুমায়ুন বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রমিত ভাষায় কথা বলে থাকেন। তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের প্রমিত বাংলা ভাষায় পাঠদান করেন। কিন্তু অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রীই উপভাষায় কথা বলে। তবে পড়ার সময় তারা প্রমিত ভাষাতেই পড়ে এবং শিক্ষকরা তাদের প্রমিত ভাষায় পড়তে সাহায্য করে থাকে। মোঃ রাজীব হুমায়ুনের কুমিল্লার উপভাষায় রচিত একটি ছড়া এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ছড়াটি হলো-
হেছা কতা কয়াম আমি
হারা জীবন দইরা,
এনের কতা হেন আমি
লাগাইতাম না গুইরা।
কামডা বালা করাম আমি
হগল খানো গিয়া,
দ্যাশের লাইগ্যা পরাণ দেয়াম
মুহে বেটকি দিয়া। কুমিল্লা জেলার অনেক বাসিন্দাই জীবিকার তাগিদে,শিক্ষা গ্রহণের জন্য শহরে পাড়ি জমায়। ফলে তাদের উপভাষায় শহরের ভাষার প্রভাব পরে।তারপরেও বলা যায় এ উপভাষা বিলুপ্তির সম্ভাবনা খুব কম।