১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তখনও সূর্যোদয় হয়নি। মসজিদের মাইক থেকে ইমামের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’- নিদ্রা অপেক্ষা নামাজ উত্তম। মুসল্লিরা কেউ কেউ মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার আকাশে যে ক’টি পাখি তখন ঘর ছেড়ে আকাশে উড়েছে, সেগুলোও হতবাক। রাজপথে মিলিটারির জলপাই রঙের ৩ টন গাড়ির কনভয়, পেছনে অন্তত এক স্কোয়াড্রন টি-৫০ মডেলের ট্যাঙ্ক। মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে শুভেচ্ছাস্বরূপ ট্যাঙ্কগুলো বাংলাদেশকে দিয়েছেন। গাড়ি ও ট্যাঙ্কে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত সেনাবাহিনীর কিছু লোক। ফার্মগেটের কাছে পৌঁছালে গাড়ির কনভয় ও ট্যাঙ্কগুলো দিক পরিবর্তন করে ধানমণ্ডির দিকে, পরে একটি গ্রুপ ধানমণ্ডি ৪ নম্বর, অপরটি ৩২ নম্বর রোডের দিকে চলে যায়। আরেকটি অংশ সোজা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে এসে ভাগ হয়ে ২৯ নম্বর মিন্টো রোড, বাকিরা রেডিও সেন্টার, শাহবাগের কাছে এসে থামে।
২৯ নম্বর মিন্টো রোডে বাস করতেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত। ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিক থেকে যে গাড়িগুলো আসছিল তারা পৌঁছার আগেই এখানে একটি জিপে ৪-৫ জন সশস্ত্র সৈনিক নিয়ে মেজর ডালিম উপস্থিত হয়ে মন্ত্রীর বাড়ির গেটে দায়িত্বরত দুই পুলিশ সদস্যকে নিরস্ত্র করে ফেলেছে। মেজর রাশেদের নেতৃত্বে ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিক থেকে তিনটি লরিতে আগত মূল দল এ বাড়ির সামনে মেইন গেটের বাইরে এসে মেজর ডালিমের কাছ থেকে কিছু একটা ব্রিফ নিয়ে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো হামলে পড়ল মন্ত্রীর বাড়ির ওপর। প্রবীণ এ কৃষক নেতা গুলির শব্দে হতবিহ্বল। দ্রুত টেলিফোন করলেন রাষ্ট্রপতিকে। কয়েক সেকেন্ড কথা বলা শেষ হতেই সেনাসদস্যরা বাড়ির দরজা ভেঙে দোতলায় উঠে এলো। মন্ত্রীর পুরো পরিবারকে টেনেহিঁচড়ে নিচতলায় মেইন ড্রইংরুমে এনে হাজির করা হয়। মন্ত্রী এদের কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গর্জনে লুটিয়ে পড়েন মন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা। রক্ষা পায়নি মাত্র চার বছর বয়সের সুকান্ত, দশ বছরের আরিফ, তের বছরের বেবি। এরপর ঘাতকরা বীরদর্পে গাড়িতে উঠে আবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হয়ে বামে মোড় নিয়ে বেতার ভবনের দিকে চলে যায়।
সবচেয়ে বড় কনভয়টি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের পূর্ব এবং পশ্চিমমুখে অবস্থান গ্রহণ করে অপেক্ষা করতে থাকে। এ গ্রুপের একটি অংশ অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে লেকের দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয় মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে। ফজরের আজানের নিদ্রা অপেক্ষা নামাজ উত্তম আহ্বানে সাড়া দিয়ে যেসব নামাজি মসজিদে যাচ্ছিলেন তারা উৎসুক চোখে এ সেনাদলের মুভমেন্ট দেখছিল। রাষ্ট্রপতির বাসভবনের গার্ডরা এই মাত্র বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষ করেছে। এ সেই জাতীয় পতাকা যার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের যৌবনকালের সম্পূর্ণ সময় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন।
বিউগলের শব্দ শেষ হওয়া মাত্র বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে লেকের ওপার থেকে মেশিন গানের ঝাঁকেঝাঁকে গুলি। মর্টার অথবা রকেট লঞ্চারের গোলা বাড়ির ওপর দিয়ে দূরে মোহাম্মদপুর একালায় গিয়ে পড়লেও শব্দে পুরো এলাকা যেন মনে হচ্ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। খুব কম সময় এ গোলাগুলি স্থায়ী হয়েছিল এবং এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টেলিফোনে তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল এবং সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হন।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ভবনের ওপর পাকিস্তানের কমান্ডো বাহিনী ঠিক এভাবেই হামলা চালিয়ে ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। অর্থাৎ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি বঙ্গবন্ধু পূর্বেও হয়েছিলেন। গোলাগুলি যখন থেমে গেল, তখন বাড়ির সম্মুখের রাস্তার পূর্ব এবং পশ্চিম দিক থেকে বুটের শব্দে বোঝা যাচ্ছিল এ বাড়ির দিকেই দৌড়ে আসছে হামলাকারীরা। মুহূর্তেই নিচতলা থেকে গুলির শব্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের আর্তনাদ। বঙ্গবন্ধু পুত্রের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেই সম্মুখে সেনাদলসহ ল্যান্সার মেজর মহিউদ্দিনকে দেখে তিনি চিৎকার করে জানতে চান ‘তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস?’ এরই মধ্যে তারা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলে নিচে নামাতে যাচ্ছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে কিছুটা ধাক্কা খেয়ে রাষ্ট্রপতি আবারও হুংকার ছাড়েন ‘তোরা বেয়াদবি করিস না’। বাইরে রাস্তায় ট্যাঙ্ক নিয়ে আসা মেজর ফারুক তখন চিৎকার দিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন ‘কিল অ্যান্ড ক্র্যাশ এভরিবডি’। এ নির্দেশ পাওয়া মাত্র নিচতলা থেকে মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন বজলু দৌড়ে ওপরে উঠতেই মেজর মহিউদ্দিন গ্রুপ পরিবেষ্টিত জাতির পিতাকে পেয়ে যায়। মেজর নূর সবাইকে সরে যেতে বললে বঙ্গবন্ধু একা হয়ে যান। সময়ক্ষেপণ না করে মেজর নূর ও বজলু হাতের অস্ত্রের ট্রিগার চেপে ধরলে অন্তত ১৮টি গুলি বঙ্গবন্ধুর বক্ষভেদ করে বেরিয়ে যায়। যে মানুষটিকে বারবার সুযোগ পেয়েও পাকিস্তানিরা হত্যার সাহস করেনি, সেই জাতির পিতাকে হত্যা করল বাঙালি সন্তানরা। এরপর হায়েনারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উপস্থিত প্রতিটি সদস্য, এমনকি শিশু রাসেলকেও হত্যা করে। সভ্যতার ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আধাঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় পাকিস্তানের আদলে রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর মন্ত্রিসভার বৈঠকে আনন্দ প্রকাশ, বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন ও নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অতএব বুঝতে বাকি থাকে না, এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাদের হাত ছিল। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন, বঙ্গবন্ধুর নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পদোন্নতি পেয়ে সেনাপ্রধান হন। খুনিদের রক্ষার্থে মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। ঘাতকদের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ মিশনগুলোতে চাকরি ও পদোন্নতি দেয়া হয়। এবার বুঝতে বাকি থাকে না এ হত্যাকাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিল।
কিন্তু ইতিহাস কি তাদের ক্ষমা করেছে? খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সম্মানিত একজন গুরুত্বপূর্ণ জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন। মাত্র ৮৩ দিন পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে, তারই সেনাপ্রধান কর্তৃক প্রদত্ত পাঁচ বছর কারাভোগ শেষে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মানুষের কাছে বাংলাদেশের মীরজাফর বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, তাকে ও তার পরিবারকে হত্যা করেছিল তাদের শাস্তি হয়েছিল এ পৃথিবীতেই। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর দীর্ঘদিন কুষ্ঠরোগে ভোগার পর মারা যায়। ঘসেটি বেগমকে পানিতে চুবিয়ে মারা হয়। মীরনের মৃত্যু হয় ইংরেজদেরই হাতে। রায় দুর্লভ দীর্ঘ কারাভোগের পর সেখানেই মৃত্যুবরণ করে এবং জগৎশেঠকে মীর কাশেম হত্যা করে। উমিচাঁদ পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মারা যায়। ধনকুবের ও ষড়যন্ত্রকারী নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। নাটের গুরু রবার্ট ক্লাইভ ১৭৭৬ সালে আত্মহত্যা করে জীবনলীলা সাঙ্গ করে। তাই ইতিহাসের শিক্ষা- বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি কখনও শুভ হয় না।