দেশে করোনা রোধে চলতি মাসেই চীনের সিনোভ্যাক টিকার ট্রায়াল শুরু হবে। ৭টি হাসপাতালে ট্রায়াল চলবে। এসব হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়রা ট্রায়ালে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবেন। আগ্রহীদের নাম তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।
নির্দিষ্ট ৭ হাসপাতাল হচ্ছে- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিট-২, একই হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল ও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল।
গত মাসে এই টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তবে দেশের মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে আরও একাধিক বিকল্প থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এদিকে বাংলাদেশে টিকা সহজলভ্য করতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে ইউনিসেফ।
এ প্রসঙ্গে আইসিডিডিআর,বি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. কেএম জামান বলেন, প্রথমে আমরা ২১০০ জনের শরীরে নমুনা টিকা প্রয়োগ করব। আর ২১০০ জনকে দেব প্লাসিবো (প্রতীকী ওষুধ)।
পরবর্তী ৬ মাস প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ ও প্রতি মাসে নিবিড়ভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। যাদের মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে তাদের নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা হবে।
প্রয়োগের আগে প্রত্যেকের শারীরিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যারা এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন কাউকে এই নমুনা টিকা প্রয়োগ করা হবে না।
সিনোভ্যাকের নমুনা টিকা সম্পর্কে ড. জামান বলেন, এই টিকা যাদের শরীরে প্রয়োগ করা হবে, তাদের মাধ্যমে অন্য কেউ সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এই টিকা মৃত ভাইরাস বহন করছে।
যা অন্যকে সংক্রমিত করতে পারবে না। যার শরীরে প্রয়োগ করা হবে, তিনিও সংক্রমিত হবেন না। বরং টিকাটি যাদের শরীরে কার্যকর হবে, তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত মাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি করবে, যা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
প্রয়োগের পর টানা ছয় মাস সবাই পর্যবেক্ষণে থাকবেন। তারা নিজেদের বাসাবাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই থাকতে পারবেন, কর্মস্থল কিংবা বাইরে সর্বত্রই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।
আর এই পরীক্ষামূলক কার্যক্রম সার্বক্ষণিক পর্যালোচনার জন্য অনেকগুলো দলের সদস্যরা একযোগে কাজ করবেন।
এক্ষেত্রে শুধু আইসিডিডিআর,বি’র গবেষকরাই নন, সরকার নির্ধারিত গবেষক দল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আরও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের পর্যবেক্ষক দল পর্যবেক্ষণ করবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২৮ আগস্ট রাতে ‘কোভিড-১৯ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় টিকার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে অধ্যাপক খুরশীদ বলেন, ইতোমধ্যে চীনা ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
টিকার বিষয়ে ইপিআই-এর সঙ্গে একটি মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লান করা হয়েছে। যেখানে কীভাবে ভ্যাকসিন বিতরণ করা হবে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে আগে ভ্যাকসিন কীভাবে আসবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ভারত অক্সফোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভ্যাকসিনের ফর্মুলা কিনে নেব। তারপর তারা সেটা নিজেরা তৈরি করে রফতানি করবে। বাংলাদেশও চাইলে এটা করতে পারে।
সরকার সরাসরি এটা কিনতে পারে। আমরা রাশিয়ায় কথা বলেছি, তারা জানিয়েছে প্রতি ডোজের দাম পড়বে ১০ ডলার, যা ব্যয়বহুল। তবে গ্যাভি অ্যালায়েন্সর মাধ্যমে আনতে প্রতিটি টিকার দাম পড়বে ২৭ টাকা।
তবে সেটি আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ের আগে পাওয়া যাবে না। অধ্যাপক খুরশীদ আরও বলেন, দ্রুত ভ্যাকসিন পেতে ডিপ্লোমেটিক প্রকিউরমেন্টে যেতে হবে।
এছাড়া ট্রায়াল চলার পাশপাশি দ্রুততম সময়ে একটি ভ্যাকসিন প্রয়োগ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ব্যবহার, সরবরাহ ও গবেষণা নীতিমালা করতে হবে।
যারা স্বেচ্ছায় এই টিকা প্রয়োগে সম্মত থাকবেন, শুধু তাদেরই সুযোগ দেয়া হবে। আইসিডিডিআর,বি’র গবেষক দলের সদস্যরা হাসপাতালগুলোয় এরই মধ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন।
এদিকে কোভিড-১৯ টিকার ডোজ কেনার পাশাপাশি পরিবহন, অবকাঠামো ও সংরক্ষণে বৈশ্বিক কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির পক্ষে উৎপাদক ও অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করবে ইউনিসেফ।
পাশপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে একত্রে নির্দেশিকা তৈরি করা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার বিষয়টি জানিয়েছে সংস্থাটি। শুক্রবার ৪ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ তথ্য জাননো হয়।
সংস্থাটি আরও জানায়, বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আশার আলো দেখাচ্ছে এবং ‘পাহো রিভলভিং’ ফান্ডের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে ইউনিসেফ ‘কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি’র পক্ষে ৯২টি নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্রয় ও সরবরাহ প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেবে।
এই দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিন ক্রয়ের ক্ষেত্রে গ্যাভি কোভ্যাক্স এএমসি পদ্ধতির পাশাপাশি জরুরি মানবিক পরিস্থিতির জন্য রাখা আপৎকালীন মজুদের মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া হবে।
এ ছাড়াও ইতোমধ্যে কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভ্যাকসিন পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা উচ্চ আয়ের ৮০টি দেশের ভ্যাকসিন ক্রয়ে সহায়তা দিতে ক্রয়-সমন্বয়কারী হিসেবেও কাজ করবে ইউনিসেফ।
উচ্চ আয়ের এই দেশগুলো তাদের নিজস্ব বাজেট থেকে এই ভ্যাকসিনের জন্য অর্থের জোগান দেবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জিএভিআই, সিইপিআই, পাহো, বিশ্বব্যাংক, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য সহযোগীর সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতার ভিত্তিতে ইউনিসেফ এই কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
সম্ভাব্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দেশ যাতে বাদ না পড়ে, তা নিশ্চিত করার জন্য ‘কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি’ সব দেশের জন্য উন্মুক্ত।
এ প্রসঙ্গ ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ভ্যাকসিন বের হওয়ার পর নিরাপদে, দ্রুত ও সমতার ভিত্তিতে সব দেশ যাতে এর প্রাথমিক ডোজ পেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য ইউনিসেফ টিকা সরবরাহের ক্ষেত্র তার অনন্য সক্ষমতা দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে।
ইউনিসেফ এককভাবে বিশ্বে ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এবং প্রায় ১০০টি দেশে নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রম ও রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার জন্য সংস্থাটি বছরে ২০০ কোটিরও বেশি ডোজ ভ্যাকসিন কিনে থাকে।
এটি ভ্যাকসিন ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভির প্রধান সহযোগী, যা গত ২০ বছরে ৭৬ কোটিরও বেশি শিশুর কাছে জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন পৌঁছে দিয়ে ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মৃত্যু ঠেকিয়েছে।
ইউনিসেফ ‘কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি’র জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্রয় ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা প্রদানে বাজার ব্যবস্থাপনা ও ক্রয় দক্ষতাকে কাজে লাগাবে। এর মধ্য দিয়ে একক সংস্থা হিসেবে ২০২১ সালে ইউনিসেফের ভ্যাকসিন ক্রয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে।