আজকের বিজয় দিবস এল এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ চলছে। এরই মধ্যে আগমনী শোনা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর। নেতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদৃষ্টি এবং জনতার স্বপ্ন আর আত্মনিবেদন একাকার হয়ে মিশে গেলে কী বিস্ময়কর ইতিহাস জন্ম নিতে পারে, তার আশ্চর্য স্বাক্ষর মুক্তিযুদ্ধ আর তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।
মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অবদান, পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীকে এটি দিয়েছে তার নিজের রাষ্ট্র; এমন এক সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার কর্তৃত্ব অন্য কারও নয়, কেবলই এর নাগরিকদের হাতে। একে এর নাগরিকেরা নিজেদের স্বপ্নে গড়ে তুলবে, নিজের নেতৃত্বে সামনে এগিয়ে নেবে, এই রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনভাবে নিজেদের আকাঙ্ক্ষা ও বিকাশের চর্চা করবে।
কার্যত পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত জাতির যে উত্তাল ও রক্তমাখা অভিযাত্রা, সেখানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল তুলনাহীন। জাতিকে তিনি ধীরে ধীরে একাত্ম করেছেন, তাদের মধ্যে ক্রমশ স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়েছেন, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে উন্মুখ করে তুলেছেন। ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং সবশেষে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তিনি জাতিকে সঙ্গে নিয়ে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত অর্জনের দিকে এগিয়েছেন। এর জন্য বহুবার কারাবরণ করেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরে আমরা পেয়েছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। মুক্ত দেশে আমাদের চাহিদা ছিল বিপুল, সম্পদ সামান্য। বঙ্গবন্ধুকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেশটিকে পুনরুদ্ধারের যজ্ঞে নামতে হয়। সেই বাংলাদেশ কোত্থেকে আজ কোথায় এসেছে! মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের প্রাক্কালে পেছনে ফিরে তাকালে এর অসামান্য অর্জনগুলো গর্বে আমাদের মাথা উঁচু করে দেয়। স্বাধীন একটি রাষ্ট্র পেয়েছিলাম বলেই তা আমরা সম্ভবপর করতে পেরেছি।
বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমাদের অর্জন এখন ঈর্ষণীয়। চোখধাঁধানো উন্নতি ঘটেছে গড় আয়ু এবং মা ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে। একসময় আমরা বিশ্বের এই কটাক্ষ শুনেছি যে কৃষি আমাদের পোষণ করতে সক্ষম নয়। অথচ এখন সবজি, মাছ ও ফলমূলে বাংলাদেশের আসন বিশ্বের প্রথম সারিতে। শিক্ষার অনুভূমিক বিস্তারে, নারীদের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে, নানা শিল্প ও বাণিজ্যের উদ্যোগে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে। ২০১৫ সালে আমরা মধ্য আয়ের দেশের কাতারে ঢুকেছি। এসব অর্জনের পথে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা কম ছিল না। তা সত্ত্বেও আমাদের এ অগ্রগতি বিশ্বের চোখে এক বিস্ময়। তারা এর নাম দিয়েছে বাংলাদেশ প্যারাডক্স বা বাংলাদেশ কুহেলিকা।
আমরা অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে এগিয়েছি, বেশ কিছু সামাজিক সূচকেও। কিন্তু আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লড়াই অন্তহীন সাধনার। এসব ক্ষেত্রে আমাদের সন্তুষ্ট হওয়ার মতো অর্জন এখনো বাকি রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মানুষ যে এমন বিস্ময় তৈরি করতে পেরেছে, মুক্তিযুদ্ধেই তার বীজ। তাই মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গৌরবময় অতীত শুধু নয়, তার প্রাণশক্তি ও স্বপ্ন দেশের বর্তমানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। আমাদের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশও এরই মধ্যে নিহিত। তাই বিজয়ের মাসে, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এর স্বপ্নের রূপরেখা বারবার আমাদের বুঝে নিতে হয়, আমাদের কর্মধারার মধ্যে মিশিয়ে নিতে হয়। নিজেদের এ প্রশ্ন করতে হয়, যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এত দিয়েছে, আমরা তাকে কী দিয়েছি?
বাংলাদেশের আয় ও উৎপাদন বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈষম্য। কিন্তু বৈষম্যের অবসান ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন। বস্তুত যে ছয় দফা স্বাধীনতার পথে আমাদের প্রথম বড় ধাপ, বৈষম্যের বিলোপ ছিল তার অন্যতম শর্ত। কারণ, পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর ও নিপীড়ক চরিত্র প্রথম আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল তার বৈষম্যের মধ্য দিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যই শুধু নয়, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকারের মতো আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো মুক্তিযুদ্ধের রক্তঢালা পথে আমরা অর্জন করেছি। ঠিক এই জায়গাটিতে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা অভূতপূর্বভাবে ব্যতিক্রমী এক জাতি। এসব মূল্যবোধ অন্যেরা পেয়েছে সভ্যতার স্বাভাবিক অর্জন হিসেবে। আমরা পেয়েছি লাখো মানুষের আত্মনিবেদনের অমূল্য উত্তরাধিকারে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরেও সরকার গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চনা আমাদের গণতন্ত্রের স্বপ্নকে অমর করেছিল। বস্তুত ১৯৬০-এর দশকজুড়ে বাংলার উত্তাল আন্দোলন ছিল গণতন্ত্রের অধিকার আদায়েরই লড়াই। প্রতিষ্ঠার পরপর পাকিস্তান দ্রুতই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পর্যবসিত হয়। এর বিপরীতে ১৯৫২ সাল থেকে বাঙালি যে আত্মপরিচয় রচনা করতে থাকে, অন্তর্নিহিতভাবেই তা ছিল অসাম্প্রদায়িক। ১৯৬০-এর দশকজুড়ে নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আত্মস্থ করে। আর একাত্তর পর্যন্ত প্রবহমান আমাদের আন্দোলন তো এক অর্থে মানুষ হিসেবে আমাদের অধিকার অর্জনেরই সংগ্রাম—নিজ নিজ রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংস্কৃতিক সত্তা চর্চার, ধর্ম পালনের, মত পোষণ ও প্রকাশের। পাকিস্তান রাষ্ট্র যে আগাগোড়াই এর বিপরীতে ছিল, তার হিংস্রতম প্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাংলাদেশের তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড তাঁর স্মৃতিকথায় একে বলেছেন ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড’ বা ‘নির্বাচিত গণহত্যা’। রাজনৈতিক বিশ্বাসে কেউ আওয়ামীপন্থী বা কমিউনিস্ট কিংবা ধর্মবিশ্বাসে সনাতন, শুধু এ কারণেই তারা পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মানবাধিকার পুনরুদ্ধারেরও যুদ্ধ। ইতিহাসের এ দায় পূরণের ভার আমাদের ওপর বর্তেছে। আমাদের তা মেটাতে হবে।
আমরা অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে এগিয়েছি, বেশ কিছু সামাজিক সূচকেও। কিন্তু আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লড়াই অন্তহীন সাধনার। এসব ক্ষেত্রে আমাদের সন্তুষ্ট হওয়ার মতো অর্জন এখনো বাকি রয়ে গেছে। অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতি যদি হয় রাষ্ট্রের বাস্তবিক বা শারীরিক পরিস্থিতির বিকাশ, মূল্যবোধ তাহলে রাষ্ট্রের চেতনার—যাকে আমরা ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি। এখানেই রাষ্ট্রের প্রকৃত পরিচয়, বিশেষ করে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে জনতার আত্মদানে।
মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য দান কীভাবে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি, আগামী বছর তার ভাবনা ও পরিকল্পনাই তাই হোক আমাদের কর্তব্য। মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠুক জাতির ভবিষ্যৎ অভিযাত্রার ধ্রুবতারা।